চৈত্রের খরতাপ, বিদ্যুতের লোডশেডিং, ভ্যাপসা গরম ও পানি সংকটে জনজীবনে নেমে এসেছে অসনীয় দুর্ভোগ। আবাদি জমি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। বিস্তারিত খবর পাঠিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা :
ধামইরহাট (নওগাঁ) : নওগাঁর ধামইরহাটে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে উপজেলা পল্লীবিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে। সেই সঙ্গে প্রবল খরার ফলে ক্ষেতখামারসহ জনজীবন নাকাল হয়ে পড়েছে। লোডশেডিংয়ের ফলে এলাকার বিদ্যুত্ ব্যবস্থা অনেকটা ভেঙে পড়েছে। দিন-রাত ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৮-৯ ঘন্টার বেশি বিদ্যুত্ থাকে না। ফলে ইরি-বোরোসহ উঁচু শ্রেণীর ধানক্ষেত পানির অভাবে শুকিয়ে মরতে শুরু করেছে। তাছাড়া গৃহস্থালি কাজকর্ম, আলিম ও উচ্চমাধ্যমিক এবং কারিগরি বোর্ডের অধীনে পরীক্ষার্থীদের বিদ্যুতের অভাবে লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুতের এই নাকাল অবস্থায় কৃষক অনেকটা হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। এদিকে এ বরেন্দ্র অঞ্চলের কঠিন ও শক্ত লালচে মাটি তাতিয়ে উঠেছে। ফলে এলাকার খালবিল, নদীনালা শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। উল্লেখ্য, চলতি বোরো মৌসুমে এ উপজেলায় প্রায় ১৮ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. মো. জামাল উদ্দিন বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে এ উপজেলা এবার ১৭ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে উফশী ও ১ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান চাষ করা হয়েছে। বিদ্যুত্চালিত ৩৫৭টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কৃষকদের মাঝে বোরো ধানের জন্য সেচ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বিদ্যুত্ সরবরাহের এ ঘাটতি পূরণ করা না গেলে এ উপজেলায় এবার ইরি-বোরো ধানচাষে লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
কাপাসিয়া (গাজীপুর) : গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সর্বত্র চলছে পানির জন্য হাহাকার; অন্যদিকে হাজার হাজার নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে ভূগর্ভস্থ পানি। কিন্তু কাপাসিয়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী গাজী ফাতেমা ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী তাসজিদ আহমেদ তার কার্যালয়ে আসেন কালেভদ্রে। এক বছর পেরিয়ে গেলেও পরিবর্তন হয়নি প্রকৌশলীর অফিসের দরজার সামনে লাগানো নেমপ্লেটটি। এখনো রয়ে গেছে আগে কর্মরত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আবদুস ছাত্তারের নাম। ফলে এলাকার সুবিধাবঞ্চিত লোকজন প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত হচ্ছে। অফিসে তাদের অনুপস্থিতির কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ও সিদ্বান্ত ঝুলে থাকে মাসের পর মাস। তবে তিনি অফিসে না এলেও ঠিকাদারের কার্য হাসিলের জন্য কখনো কখনো কাপাসিয়ায় এসে থাকেন।
উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, পানির জন্য উত্কন্ঠা ও হাহাকার উপজেলা সদরসহ বারিষাব, টোক, সিংহশ্রী, দূর্গাপুর, চাঁদপুর, তরগাঁও ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গ্রামের বেশির ভাগ এলাকার হাজার হাজার নলকুপ অকেজো হয়ে পড়েছে। যে কয়টি গভীর নলকুপ আছে তাও সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হওয়ার পথে। তাই কাপাসিয়ার সাড়ে চার লাখ মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ধরনা দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে, কিন্তু তার দেখা পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার। খোদ অফিসের কর্মচারীরাই তাকে মাসে ২-৪ বার অফিসে আসতে দেখেন বলে জানান। তবে তিনি নিয়মিত অফিস না করেও বহাল তবিয়তে সরকারি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছেন।
গত অর্থবছরে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৬২টি সাব-মার্সেবল বসানো হয়েছে। কিন্তু তার বেসিন ট্যাংকির কাজ হয়েছে শুধু ৩৮টির। কাজের মান অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়ায় তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ কর্তাব্যক্তিদের যোগসাজশে গাজীপুর সদরের মেকানিক মাহফুজ নিজেই ঠিকাদারের হয়ে কাজগুলো সম্পন্ন করে থাকেন। এ ব্যাপারে উপ-সহকারী প্রকৌশলী তাসজিদ আহমেদ বলেন, আমি নিয়মিত অফিসে আসি না। কারণ অন্যত্র বদলি হয়ে যাব। এছাড়া কর্তব্যরত ঠিকাদারি কোম্পানি হয়ে কাজ করি না এবং আমার এখানে কোনো নিম্নমানের কাজ হচ্ছে না। চৈত্রের এ প্রখর রোদে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে আর বিকল হয়ে পড়ছে উপজেলার অধিকাংশ নলকূপ। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ও উপ-সহকারীর অনুপস্থিতির বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলাউদ্দিন আলী বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা অফিসে না আসাটা খুবই দুঃখজনক। এ ব্যাপারে গাজীপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো. মোস্তফার সাথে তার মোবাইল নম্বরে (০১৬৮৪৫৪৬৯৯৫) বার বার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
পুঠিয়া (রাজশাহী) : রাজশাহীর পুঠিয়ায় চলতি বছর বোরো মৌসুমে বীজ, রাসায়নিক সার, ডিজেল, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ও অনুপাতিক হারে বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে ভূগর্ভস্তরের পানি ক্রমেই নিচে নেমে যাওয়াসহ নানামুখী সমস্যায় ভুগছেন স্থানীয় কৃষকরা। বিগত বছরগুলোতে ধানের মূল্য কম থাকায় খরচের টাকাও ওঠাতে পারেননি তারা। চলতি বছর আবারো লাভের আশায় বোরো ধান রোপণ করেছেন কৃষকরা। দফায় দফায় লোকসান গুনে সর্বস্বান্ত হয়ে পরেছেন তারা। বোরো ধানের ওপর সরকারিভাবে কৃষকদের আর্থিক সহায়তা করার দাবি করছেন কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন এলাকায় ১৯১টি গভীর নলকূপ ও আড়াই শতাধিক অগভীর নলকূপের অধীনে ২ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। আর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি হেক্টরে ৪.৬৭ মেট্রিক টন। গত বোরো মৌসুমে ২ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়। বিগত বছরের লোকসান পুষিয়ে নিতে এ বছর আরো ৮০ হেক্টর বেশি জমিতে বোরো ধান রোপণ করা হয়েছে।
জানা গেছে, উপজেলায় ১৪ হাজার ৯৫০ জন কৃষক কৃষি খাতের ভর্তুকির আওতায় রয়েছেন। তবে শিলমাড়িয়া এলাকায় মাত্র ৪০ জন চাষীকে আউশ ধান রোপণের জন্য ভর্তুকি দেয়ার প্রক্রিয়া করা হচ্ছে বলে কৃষি অফিস জানায়।
এদিকে কৃষি উপকরণ বীজ, ডিজেল, রাসায়নিক সার-কীটনাশক ও দিনমজুরের পারিশ্রমিক দফায় দফায় ঊর্ধ্বগতিতে স্থানীয় কৃষকরা চরম আতংকে রয়েছেন। এরপর অনাবৃষ্টির কারণে ক্রমেই ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর নেচে নেমে যাওয়ায় অনেক সেচপাম্পগুলোতে পানি উঠছে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলায় কৃষি কর্মকর্তাদের নজরদারির অভাবে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে শত শত সার-কীটনাশকের দোকান। আর এসব দোকানে ভেজাল সার ও কীটনাশকের ব্যবসা করছেন একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। যার ফলে তারা এলাকার সাধারণ কৃষকদের সাথে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। আর জমি ক্রমেই হারাচ্ছে উর্বর ক্ষমতা। শিলমাড়িয়া এলাকার কৃষক তোফাজ্জল হোসেন, কাঁঠালবাড়ীয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম ও ভালুকগাছি গ্রামের সামসুল হকসহ অনেকেই জানান, দিন যতই যায় কৃষি উপকরণের দাম ও খরচ ততই বেড়ে যায়। জ্বালানি তেল, বিদ্যুত্, সার ও দিনমজুরি লাগামহীনভাবে বাড়ছে। গত বছরগুলোতে প্রতি বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে ৭ থেকে ৯ হাজার টাকা। এ বছর ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হবে। আমরা যে অর্থ ব্যয় করে বোরো ধান রোপণ করি তা বিক্রি করে খরচের অর্ধেক টাকাও এখন আসে না। এ বছর ধানের দাম বাড়ানো না হলে কৃষকরা ক্রমেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মন্জুর রহমান জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর কিছু বেশি জমিতে বোরো ধান রোপণ করা হয়েছে। তবে অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করলে ফলন অনেক বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর সারা দেশেই কৃষিতে সরকারিভাবে সার ও বিদ্যুতের ওপর ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে।