অধিকার-এর মাসিক প্রতিবেদন : মার্চ মাসে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার মহোত্সব নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হয়েছে
দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জানিয়েছে, মার্চ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২২ জন নিহত এবং ১ হাজার ৩৫০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় আওয়ামী লীগের ২৯টি এবং বিএনপির ৩টি অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৩ জন এবং বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ১ জন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
মার্চ মাসে মোট ২৭ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে দেশের ১৪ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে, বিএসএফের হাতে ২ জন এবং ১১ জন গণপিটুনিতে মারা গেছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ১৪ জনের মধ্যে ৭ জন তথাকথিত ‘ক্রসফায়ার/ এনকাউন্টার/ বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্রসফায়ারে নিহতদের মধ্যে র্যাবের হাতে ৪ জন এবং পুলিশের হাতে ৩ জন মারা গেছেন বলে জানা গেছে। এ সময়ে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে ১ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত ১৪ জনের মধ্যে ৫ জন গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে ২ জনকে পুলিশ, ২ জনকে র্যাব এবং ১ জনকে সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সময়ে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে ১ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ১ জনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে।
মার্চ মাসে ৪ জন ‘অসুস্থতাজনিত কারণে’ কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে জানা গেছে।
এ সময় ১ জন সাংবাদিক নিহত, ৭ জন আহত এবং ৩ জন হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অধিকার সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনার নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে এবং সেই সঙ্গে হামলাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানাচ্ছে। প্রায়ই দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অস্থিরতার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে নিজের হাতে আইন তুলে নেবার প্রবণতা দেখা দিয়েছে বলে অধিকার মনে করে।
অধিকারের তথ্য অনুযায়ী গত মাসে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ ২ জন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করেছে। এ সময় গুলিতে আহত হয়েছে ৩ জন। একই সময়ে বিএসএফের হাতে অপহৃত হয়েছেন ১২ জন।
উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, সহিংসতা ও বেশ কয়েকজনের নিহত হওয়ার তথ্য তুলে ধরে অধিকার বলছে, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য না দেখিয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা ছিল নির্বাচন কমিশনের অবশ্যকর্তব্য। অথচ এই নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
অধিকার মনে করে, বাংলাদেশে শক্তিশালী একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা অত্যন্ত জরুরি যা দ্রুততম সময়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে।
নিহতদের পরিচয়
নিহত ১৪ জনের মধ্যে ১ জন আওয়ামী লীগ সমর্থিত উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী, ১ জন যুবলীগ কর্মী, ১ জন উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর পোলিং এজেন্ট, ১ জন বিএনপি’র বিদ্রোহী চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর স্ত্রী, ১ জন ঠিকাদার ও ১ জন সহকারী ঠিকাদার, ১ জন সাংবাদিক, ১ জন দিনমজুর এবং ৬ জন কথিত অপরাধী বলে জানা গেছে।
অধিকার-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকায় দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা প্রতিনিয়তই হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। ভিকটিমদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে, তাঁদের সামনেই আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের স্বজনদের গুলি করে হত্যা করেছে। বারবার দোষীদের বিচারের সম্মুখীন করার দাবি জানানো হলেও সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অস্বীকার করছে।
৩ মার্চ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে দুইজন নিহত হয়েছেন, যা রাজনৈতিক সহিংসতার পরিসংখ্যান অংশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দায়মুক্তির সংস্কৃতি প্রবলভাবে বিরাজমান। এছাড়া দায়িত্বশীল পদে থেকেও সরকারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে বক্তৃতা করছেন।
অধিকার-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ৮ মার্চ ঢাকা মহানগরের বিয়াম অডিটোরিয়ামে বিবিসি-বাংলাদেশ সংলাপে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে, আন্দোলনের নামে গাড়ি পোড়ায়, মানুষের হাত-পায়ের রগ কাটে তাদের যদি ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হয় সেটা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নয়।’
গত ৩ মার্চ ২০১৪ সকাল আনুমানিক ১১টায় ঢাকার কদমতলী থানার ১৩১ নম্বর নতুন জুরাইন এলাকার নিজ বাড়িতে র্যাবের কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হন ঠিকাদার মোহাম্মদ ওয়াসিম ও তাঁর সহকারী সংগ্রাম চৌধুরী। নিহতদের পরিবারের অভিযোগ বাড়ি থেকে ধরে তাঁদের সামনেই র্যাব সদস্যরা ওয়াসিম ও সংগ্রামকে গুলি করে হত্যা করেছে। শুধু তা-ই নয়, তাঁদেরই কয়েকজন কর্মচারীকে আটক করে পিটিয়ে ওয়াসিম ও সংগ্রাম তাঁদের অপহরণ করেছিল বলে র্যাব মিথ্যা বক্তব্য আদায় করে বলে অভিযোগ করেন ওয়াসিমের স্ত্রী সোনিয়া বেগম ও সংগ্রামের স্ত্রী সালমা চৌধুরী। তাঁদের দাবি পোস্তগোলা ব্রীজের টোল আদায় নিয়ে আলমবাগের জনৈক আলমের ছেলে বাবুলের সঙ্গে বিরোধকে কেন্দ্র করে টাকার বিনিময়ে পরিকল্পিতভাবে র্যাব সদস্যরা তাঁদের হত্যা করে। নিহত মোহাম্মদ ওয়াসিমের স্ত্রী সোনিয়া বেগম অধিকারকে জানান, মোহাম্মদ ওয়াসিম পোস্তগোলা ব্রীজের টোল আদায় করার পাশাপাশি আলমবাগ সিএনজি স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করতো। ৩ মার্চ ২০১৪ সকাল আনুমানিক ১১ টায় ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যান মোহাম্মদ ওয়াসিম। এর আগেই সকাল আনুমানিক ৯ টায় ওয়াসিমের ব্যবসায়িক সহকারী সংগ্রামসহ বেশ কয়েকজন শ্রমিক বাড়ির ৭ তলা ভবনের ৬ষ্ঠ তলার অফিসরুমে ওয়াসিমের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় বাড়ির নিচ থেকে গুলির শব্দ পান তাঁরা। সাদা পোশাকের একদল অস্ত্রধারী ওয়াসিমের নাম ধরে গুলি করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে ভবনের সাত তলায় তাঁদের বাসায় উঠে আসতে থাকে। এ সময় তিনি বাসার মূল দরজা বন্ধ করে দেন। র্যাব সদস্যরা এসে দরজায় লাথি মারতে থাকে। একপর্যায়ে সোনিয়া বেগম দরজা খুলে দিতে বাধ্য হন। সঙ্গে সঙ্গে ৪/৫ জন অস্ত্রধারী ঘরে ঢুকে ঘরের আসবাবপত্র লন্ডভন্ড করে ফেলে এবং বাথরুমের দরজা ভেঙে মোহাম্মদ ওয়াসিমকে টানতে টানতে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। ঘরের বাইরে সিঁড়িতে নিয়ে ওয়াসিমের গায়ে পিস্তল ঠেকিয়ে ৪/৫ রাউন্ড গুলি করে। এ সময় তিনি (ওয়াসিমের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সোনিয়া বেগম) স্বামীর জীবন ভিক্ষা চান। এতে রেগে গিয়ে ওই র্যাব সদস্য তাঁকে থাপ্পড় মেরে ও ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেয় এবং পকেট থেকে ২/৩ টি অস্ত্র বের করে বলে এগুলো তোদের বাসা থেকে পাওয়া গেছে। একপর্যায়ে র্যাব সদস্যরা তাঁদের ঘরের ভেতরে রেখে বাইরে থেকে দরজা আটকে দেয়। এর কিছুক্ষণ পর ২ জন পোশাক পরিহিত র্যাবের মহিলা সদস্য তাঁদের বাড়িতে আসে এবং তাঁকে ও তাঁর মা শিরিন আক্তারকে একটি রুমের ভেতরে আটকে রাখে। বেলা আনুমানিক ৩ টায় স্থানীয় প্রতিবেশীরা এসে বন্ধ দরজা খুলে তাঁদের মুক্ত করেন।
তিনি ধারণা করেন, ওয়াসিমকে গুলি করার সাথে সাথেই তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি আরো বলেন, এর আগে ২০১৩ সালের জুন মাসে র্যাবের একটি দল ওয়াসিমকে অপহরণ করে ‘ক্রসফায়ারে’ দেয়ার হুমকি দেয়।
সেই সময় তারা ওয়াসিমকে বলে বাবুল তাকে ‘ক্রসফায়ারে’ মারতে ৩০ লাখ টাকা দিয়েছে। এটা শুনে ওয়াসিমের জীবন রক্ষার জন্য তাঁরা র্যাবকে ৬০ লাখ টাকা দেন। নিহত সংগ্রামের স্ত্রী সালমা চৌধুরী অধিকারকে জানান, প্রতিদিনের মতো গত ৩ মার্চ ২০১৪ সকাল আনুমানিক ৯ টায় সকালের নাস্তা করে বাসা থেকে বের হয়ে সংগ্রাম পাশের ভবনে ওয়াসিমের বাসায় যান। সকাল আনুমানিক ১১ টায় ভবনের নিচে মানুষের চিত্কার ও গুলির শব্দ শোনেন তিনি আর তাঁর মেয়ে শান্তা বারান্দায় এসে দেখতে পান সংগ্রাম ওয়াসিমের বাড়ির পাইপ বেয়ে নিচে নামছে। তখন সাদা পোশাকের র্যাব সদস্যরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে। সংগ্রাম গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। এরপর আরো কয়েকটি গুলির শব্দ শোনেন তিনি এবং পোশাক পরিহিত একদল র্যাব সদস্য তখন ওই এলাকায় আসে। তাঁর মেয়ে শান্তা নিচে নেমে সাদা পোশাকের এক র্যাব সদস্যকে তাঁর বাবাকে হাসপাতালে নেবার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু ওই র্যাব সদস্য শান্তাকে ধমক দিয়ে ও গুলি করার ভয় দেখিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
অধিকার মনে করে, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কোন ব্যক্তি অপরাধী কিনা তা নির্ণয় করে শাস্তি দেবে আদালত। অথচ দেখা যাচ্ছে র্যাব এবং পুলিশের একদল সদস্য বিভিন্ন ধরনের দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে জড়িত হয়ে অথবা নির্দেশিত হয়ে এই ধরনের হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
অধিকার অবিলম্বে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের সম্মুখীন করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে।