‘যখন কবিতা লিখি দুঃখ এসে পাশে বসে থাকে’

ধনঞ্জয় রাজকুমার ছদ্মনামেই বেশি পরিচিত মণিপুরি ভাষার প্রধান কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ। ভারতের আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার পাকইরপাড়ে জন্ম নেওয়া এই কবি প্রথম জীবনে বাংলা ভাষায় লিখলেও পরবর্তী সময়ে তাঁর যাত্রা কেবল মণিপুরি সাহিত্যের বিচিত্র পথে। কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্য ও অনুবাদেও পেয়েছেন সিদ্ধি। সম্প্রতি বাংলাদেশে এলে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ মণিপুরি কবি শুভাশিস সিনহা

 

শুভাশিস সিনহা: আপনার লেখালেখি জীবনের শুরুর দিকের কথা জানতে চাই। 
ধনঞ্জয় রাজকুমার: আমি ছোটবেলায় রাজর্ষি, বিদ্যাসাগরের শকুন্তলা ইত্যাদি বই পড়েছিলাম। লিখব এ কথা ভাবিনি। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, একটা ছেলে বলল, আমার কবিতার খাতাটি সে দেখবে, নিরুপায় হয়ে দুটো কবিতা লিখে দেখালাম তাকে। কিন্তু সেগুলো ওর পছন্দ হলো না। তো, সেই যে ভয় ভাঙল, তার পর থেকে আর কোনো দিন লেখায় ছেদ পড়েনি। গ্রামে আমার এক দাদা, তিনি মণিপুরি ভাষায় গান লিখতেন। তাঁকে দেখে মনে হলো, আমিও তো লিখতে পারি। তার পর থেকে বাংলার পাশাপাশি মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া দুই ভাষাতেই লিখেছি। এর মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলাম। আশ্রয় নিলাম সেখানকার সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে। তখন মনে হলো, আমার বোধ হয় নিজের মাতৃভাষাতেই লেখা উচিত। এর পর থেকে আমি প্রধানত মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় লিখতে শুরু করলাম। 
শুভাশিস: আপনার জনসংস্কৃতি ও পরিবেশ লেখালেখিতে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে?
dধনঞ্জয়: কৈশোরে মামার বাড়িতে, একটা গণ্ডগ্রামে পড়াশোনা করেছি। তখন থেকেই দরিদ্র-দুঃখী-অনাহারী সরল মানুষগুলোকে চিনতে শুরু করলাম। অনুভব করলাম, ওঁদের ছোট্ট হূদয়ে আছে অজস্র ভালোবাসা এবং দুঃখের মধ্যে বেঁচে থাকার আনন্দ। এই মানুষগুলোই আমার লেখালেখিতে বারবার ফিরে এসেছে। যেমন আমার হপনর বাবুয়ানি (স্বপ্নের বাবুগিরি) কবিতায় একজন অনাহারী কিছু না-পাওয়া ব্যর্থ মানুষের কথা বলতে চেয়েছি। এভাবে প্রতিটি বইয়ে আমার অজান্তে এই ছোট ছোট মানুষগুলো অক্ষরের সারি হয়ে বসে যায়। 

 

শুভাশিস: আপনি একই সঙ্গে বাংলা এবং নিজের মাতৃভাষায় সমান গতিতে লিখে যাচ্ছেন। এ দুটো ভিন্ন ভাষায় লিখতে গিয়ে অভিজ্ঞতা বা উপাদানগত সন্নিবেশের কোনো ভিন্নতা অনুভব করেন?
ধনঞ্জয়: সম্পূর্ণ দুই জগৎ। বাংলা এত বেশি সমৃদ্ধ, গম্ভীর ও নাগরিক, এ ভাষায় কোনো কিছু প্রকাশ করতে যে আধুনিকতা ধরতে হয় মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় তা লাগে না। এখানে নিজের শিকড়, সংস্কৃতি ও গ্রাম্যতা—এগুলোকে ধরেই আধুনিকতায় আসতে হয়। দুটো ভাষা সম্পূর্ণ দুই রকম। 
শুভাশিস: ভারতবর্ষের অন্যান্য ভাষার তুলনায় মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া কাব্যসাহিত্যের অবস্থান কীভাবে বিচার করবেন?
ধনঞ্জয়: এ ভাষা এক অতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা। কত দিন টিকে থাকবে জানি না, পাঠক খুব কম। এরই মধ্যে যে কাজগুলো হচ্ছে, সেসব কাজ নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। এ ভাষা তুলনামূলকভাবে বেশ কিছু ভাষার চেয়ে উন্নত। মাঝেমধ্যে বাংলা বা ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। তখন বাইরের পাঠকের যে প্রশংসা পাওয়া যায়, তা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। 
শুভাশিস: কবিতায় আপনি বলেছেন, ‘তার পরও “নেই”র কথাই বলে যাব আমি’, এই যে নেই বা শূন্যতাবোধ, একেই আপনি বাকভঙ্গিমায় অসাধারণভাবে প্রকাশ করেন...
ধনঞ্জয়: আসলে প্রতিটি মানুষ কখনো কখনো নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে। এই নিঃসঙ্গতা মিশে আছে মানুষের দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে। আমি নিজেও সে নিঃসঙ্গতা অনবরত অনুভব করি। আর কবি তো একাকীই। জীবনে আমি এত দরিদ্র মানুষ দেখেছি, যাঁরা এই ‘নেই’ নিয়েই বেঁচে আছে। তাঁদের কথা স্বাভাবিকভাবে আমার কবিতায় এসেছে। এর কৃতিত্ব আমার নয়, ওই মানুষদের মনের মধ্যেই রয়েছে আমার কবিতার বীজ। 
শুভাশিস: আপনার সাহিত্যিক তৎপরতা সম্পর্কে বলুন...
ধনঞ্জয়: আমি যখন স্থির করলাম প্রধানত এই ভাষাতেই কাজ করব, তখন ভাষাটির মর্মের মধ্যে প্রবেশ করতে চাইলাম। সে জন্যই প্রবাদ-প্রবচন, লোকগীতি এবং লোকজীবনের সব দিকেরই পরিচয় জানতে চেষ্টা করলাম। সেগুলো সংগ্রহ করলাম। এ ছাড়া অল্প বয়সে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবাসী পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম যে একটা উন্নতমানের আধুনিক পত্রিকা না হলে সেই ভাষার উন্নতি ঘটে না। আমি প্রতিশ্রুতি নামে একটা কাগজ প্রকাশ করে এ ভাষার মানকে উন্নত করতে চেয়েছি। আবার যেসব ক্ষেত্রে কাজ হয়নি, সেই ফাঁকফোকরগুলো ভরাট করার দায়িত্বও আমার বলে ভেবেছি। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় থাকা যেকোনো লেখক-পাঠকের জন্য জরুরি। তাই বিভিন্ন ভাষা থেকে অনুবাদও করেছি। 
শুভাশিস: আপনার অনুবাদকর্মগুলো নিয়ে জানতে চাই। প্রথমেই রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম...
ধনঞ্জয়: ওমর খৈয়াম পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর আধুনিকতা খুবই বিস্ময়কর। এটিই আমার প্রথম অনুবাদের বই। জাপানি হাইকু কবিতার ঘনত্ব আমাকে যখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাল, ভাবলাম দেখিই না; হয়ে গেল মিকুপর চেরিফুল। 
শুভাশিস: রবীন্দ্রনাথের অনেক সাহিত্যকর্ম আপনি মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় অনুবাদ করেছেন...
ধনঞ্জয়: রবীন্দ্রনাথ ছোটবেলা থেকেই আমার ওপর ভর করে আছেন। রবীন্দ্রনাথ না পড়লে বেঁচে থাকাই বিস্বাদ হয়ে যেত। স্রষ্টাকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে আলো-বাতাস দিয়েছেন, নীল আকাশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকেও দিয়েছেন। একবার ঘুমের মধ্যে একটা রবীন্দ্রসংগীতের লাইন স্বপ্নে গাইছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো, ঘর যেন ধূপের গন্ধে ভরে গেছে। আমার সারাজীবনের ইচ্ছে ছিল রবীন্দ্রনাথের ছন্দ ও ভাষা ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করার। অনুবাদে সেই চেষ্টাই করেছি। 
শুভাশিস: আপনার কবিতায় ছন্দের বিচিত্র ব্যবহার দেখা যায়। কবিতায় ছন্দের উপযোগিতা বিষয়ে কী বলবেন?
ধনঞ্জয়: ছন্দ হচ্ছে কবির একটা শক্তি। বিশ্বের সব কবি ছন্দ নিয়ে বিচিত্র সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, এখনো করছেন। ছন্দ জানা নেই এমন কারও পক্ষে কবিতার সমগ্রতায় আসা কঠিন। গদ্য কবিতায়ও ছন্দ আছে। সেটাকে ধরার জন্য প্রচলিত ছন্দ কানে বাজাতে হয়। তাই অনেক গদ্যকবিতা কবিতা শেষমেশ হয়ে ওঠে না। ভাষার ম্যাজিক ও মিউজিক ছন্দ দিয়েই ধরতে হয়। 
শুভাশিস: আপনার পরবর্তী সময়ের মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া সাহিত্যের সম্ভাবনা কতটুকু?
ধনঞ্জয়: প্রচুর। আজকের দিনের কবিরা বিশ্বের কাব্য-আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত। তাঁরা উত্তর-আধুনিকতা ইত্যাদিকে কবিতায় ভাষা দিতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো একটি ইজমের কারাগারে একজন কবি বন্দী হয়ে থাকবেন, এটা ভালো কথা নয়। কবি কবিতায় স্বচ্ছন্দভাবে বিচরণ করবেন, যা অনুভব করবেন, তা-ই লিখবেন। জোর করে কোনো তত্ত্বের দাস হওয়া কবিতার পক্ষে ক্ষতিকর। 
শুভাশিস: সাহিত্যের প্রতিটি শাখাতেই আপনি বিচরণ করেছেন, সফল হয়েছেন। এটি কি আপনার শিল্পমনের তৃষ্ণা, নাকি পিছিয়ে থাকা একটি ভাষার সাহিত্যকে পূর্ণ করে তোলার আকাঙ্ক্ষা?
ধনঞ্জয়: দুটোই। তবে রবীন্দ্রনাথকে দেখে শিখেছি যে একই ধরনের লেখায় নিজেকে বন্দী না রেখে বিচিত্র সব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখা দরকার।
শুভাশিস: বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে কিছু বলুন...
ধনঞ্জয়: বাংলাদেশের সাহিত্য বলতে প্রধানত কবিতার সঙ্গেই আমি পরিচিত। এখানকার কবিতা পড়তে পড়তে অনেক সময় আমার দেখার চোখ বদলে গেছে। বাংলাদেশের কবিতার কাছে আমি ঋণী। শামসুর রাহমানের কবিতা ভারতের চতুরঙ্গ পত্রিকায় পড়ে এখানকার কবিতা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। সেই উৎসাহ এখনো অটুট। 
শুভাশিস: আপনি সব ধরনের লেখাই লিখেছেন। উপন্যাস লেখেননি...
ধনঞ্জয়: ১৯৬২তে অহল্যা নামের একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। পরে দেখলাম, এটা উপন্যাস হয়নি। আমাদের সমাজে উপন্যাস লেখা সম্ভব নয়। কম জনসংখ্যা, পেশার বৈচিত্র্যহীনতা, সামাজিক গণ্ডিবদ্ধতার কারণে একটা কাল্পনিক চরিত্র বা স্থান ব্যবহার করলে তা অবাস্তব হয়ে ওঠে। আমার প্রথম উপন্যাসটি একটা বড়গল্প হয়েছে, আর কিছু কিছু অংশ ছোটগল্প। এখন হয়তো ধীরে ধীরে বৈচিত্র্য আসছে। কেউ না কেউ হয়তো লিখবেন। 
শুভাশিস: বাংলাদেশ থেকে আজীবন সম্মাননা পেলেন। অনুভূতি জানতে চাই।
ধনঞ্জয়: এ বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মণিপুরি তথ্য-গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্থা পৌরির পক্ষ থেকে আমাকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। যেকোনো পুরস্কার বা সম্মাননাই তো ভালো লাগে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ আমাকে এই শিক্ষাই দিয়েছেন, ‘নোবেল পুরস্কারের দ্বারা কোনো রচনার গুণ বৃদ্ধি হতে পারে না।’ আমার কথা হলো, অনবরত ভালো লিখতে পারাই কবির বা লেখকের বড় পুরস্কার।
শুভাশিস: কবিতায় লিখেছেন, ‘দুঃখ মাচুর হমাজক’ বা দুঃখরঙের সখী। তাই আপনাকে বলা হয় অনন্ত-দুঃখের কবি... 
ধনঞ্জয়: আমি অনেক দুঃখী মানুষ দেখেছি। তাঁদের দুঃখ আমার মনে ছায়া ফেলেছে। ব্যক্তিগতভাবেও আমি খুব দুঃখী। তাই দুঃখ ও হাহাকারের কথা বারবার আমার কবিতায় এসেছে। দুঃখ সর্বদেশের সর্বকালের কবিদের সখী। আমিও যখন কবিতা লিখি, দুঃখ এসে আমার পাশে বসে থাকে।

 


ধনঞ্জয় রাজকুমারের কবিতা

তোমার মুখটি

পুরাতন বিশ্বাসের মতো ভেসে যায় তোমার মুখটি। 
বৃষ্টির কণারা বলে, দিন যে বিফলে গেল।
উঠানের দূর্বা! তোমরাই সাক্ষী থেকো, এখানে ছিলাম আমি। 
অন্ধকার নদী হয়ে কোথায় ছুটেছে। আবার দেখতে ইচ্ছে করে, 
শ্রাবণরাতের সুর ভাদ্র পার হয়ে আশ্বিনের পূর্ণিমার আজও পায়নি সন্ধান।
সে পদযাত্রার দলে আমিও তো আছি।

 

যেদিকে যা দেখি সব ভেঙে পড়ে আছে। এসবের মাঝেও কেবল তোমার মুখটি থাকবে ভেবেছিলাম, তাও ভেঙে যাচ্ছে আজ।

 

হূদয়ের অন্ধকারে
হূদয়ের অন্ধকার পথে একটি পাখি সখীর সন্ধানে উড়ে গেল। রাতের চাঁদের আলো মাঠে, জারুলের ফুল-ঝরা মাটিতে, তমালবনে, পুবের খেতের আলে লুকিয়ে খুঁজছে তাকে।
পাখিটির বিরহের সুর ঘর-দোর সবই যে ভাসিয়ে দিল আজ।
খানিক পরেই এই বেদনার বুকে ফুটে উঠল ফুল, কৃষ্ণপক্ষে অন্ধকার চাঁদের মতন।
মণিপুরি ভাষা থেকে অনুবাদ: শুভাশিস সিনহা

 

ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপন
addd
addd
addd
addd

Perfect Facebook Like Box Sidebar