শেষ যাত্রা!
শরীরে বার্ধক্য, জড়িয়েছে বিতর্কেও। বিদায় বেলায় নাম উঠেছে বিশ্ব উড্ডয়ন ইতিহাসের পাতায়। শেষ যাত্রীবাহী সফরের দিনে ঘুরে এসে লিখেছেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
প্রচণ্ড শব্দে চালু হয়ে গেছে ইঞ্জিন। নড়তে শুরু করেছে ম্যাকডনেল ডগলাস ডিসি-১০। সকালের সোনা রোদ পিছলে যাচ্ছে তার সাদা শরীরে। ঘুরতে শুরু করেছে চাকা। গতির শিহরণ তার প্রবীণ ডানায়। তার ফেলে আসা দিনের কথা মনে করিয়ে দিতেই যেন শুরুতে পিছিয়ে গেল খানিক। তারপর নাক ঘুরিয়ে ছুটতে শুরু করল রানওয়ে ধরে। দখিন মাথায় গিয়ে থামল মুহূর্তের জন্য। তারপর গতি বাড়ল প্রচণ্ড। হাওয়ায় ভাসল শরীর। যেমনটি সে ভেসেছে দুদশকের বেশি সময় ধরে। ঢাকার এই রানওয়ে, এই রোদ্দুর, এই আচমকা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দেওয়া—সবকিছুই তার কাছে বড় বেশি চেনা, বড় বেশি পুরোনো।
ককপিটেও সেদিন ভিন্ন আবহদূর আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে ডিসি-১০। তাই আবারও তড়িঘড়ি ছুটলেন নাছোড়বান্দা ফটোসাংবাদিক আর চিত্রগ্রাহকের দল। আজ প্রহরীদের বাধা মানতে রাজি নন তাঁরা। কারণ তাঁরা জানেন, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ডিসি-১০-এর এই উড়াল অন্য সব উড়ালের চেয়ে আলাদা। এই উড়াল সেই উড়াল যা বিশ্বের উড্ডয়ন ইতিহাসে লেখা থাকবে যাত্রীসমেত ডিসি-১০ বিমানের সর্বশেষ উড্ডয়ন হিসেবে।
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই সোজা বিমানবন্দরে। আগের দিন বাংলাদেশ বিমানের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, তার উড্ডয়নের সময় সকাল সাড়ে আটটা। সে হিসাবে সময় প্রায় হয়ে এসেছে। কেউ একজন জানাল, ওটা আছে ‘ডোমেস্টিক’ টার্মিনালে। রানওয়েতে নামার অনুমতি মিলতে মিলতে সাড়ে আটটা। নাহ! ছেড়ে যায়নি তখনো। অতিকায় ডানা মেলে রানওয়েতে অপেক্ষমাণ ডিসি-১০ উড়োজাহাজ। তাকে ঘিরে দেশির চেয়ে ভিনদেশিদেরই ভিড় বেশি। ডিসি-১০-এর শেষ যাত্রীবাহী সফরের টিকিট বিক্রি হয়েছে আগেই। ইতিহাসের সাক্ষী হবার সুযোগ লুফে নিতেই অনেক ভিনদেশি হাজির।
আজ সিঁড়ি ভেঙে ককপিট পর্যন্ত চলে যেতে বাধা নেই। ককপিটে বসেই ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বলছিলেন এই ডিসি-১০ ঘিরে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা।
বছরের পর বছর এই উড়োজাহাজ নিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়েছেন কাইয়ুম ও তাঁর দুই সহকর্মী। ককপিটে বসেই উড্ডয়নের আগ মুহূর্তে তিনি বলছিলেন, ‘শেষবারের মতো যাত্রী নিয়ে যাচ্ছি, আবেগময় মুহূর্ত তো অবশ্যই। এখন আমরা যাব কুয়েত। সেখান থেকে বামিংহাম।’
বিমানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ভিনদেশি যাত্রী আর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের ভিড় ঠেলে ককপিট থেকে বেরিয়ে আসি। আজ বিমানের এমাথা-ওমাথা ঘুরতে বাধা নেই কোনো।
ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরাও বেমালুম জানেন আজকের যাত্রাটা অন্য রকম। তাই মাপা হাসির বাইরে বাড়তি উত্তেজনা তাঁদের মধ্যেও।
সোয়া নয়টার মতো বাজে। দরজার সঙ্গে লাগোয়া সিঁড়ি সরে যাবে। আমরা নেমে আসি দ্রুত। বাংলাদেশের তিনজন স্পটারকে দেখা যাচ্ছে বিমানের আশপাশে। তাঁদের সঙ্গেই কথা বলছিলেন জর্জ রিলেডার। বাংলাদেশ বিমানের গ্রাহকসেবা বিভাগের পরিচালক। কাজে যোগ দিয়েছেন মাস তিনেক হলো। বাংলাদেশ বিমানের প্রাচীনতম সংগ্রহের ‘শেষ যাত্রা’র দিনে কী ভাবনা নবীনতম এই কর্মকর্তার?
‘এই লেখাটা দেখো (বিমানের ডান পাশে বাংলায় লেখা ‘নবযুগ’)। ওখানে লেখা “নিউ এরা”। একদিন এই বিমানটা নতুন যুগের প্রতিনিধি ছিল, আজ সেটা পুরোনো হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চলে যাচ্ছে। কী অদ্ভুত তাই না?’
ডিসি-১০-এর শেষ যাত্রী বহনের দিনে এই কানাডিয়ানকে খানিক ভাবুকের মতো দেখায়।
সিঁড়ি সরে গেছে।
যাবতীয় কাজ সারা। পিছিয়ে গিয়ে রানওয়েতে ছুটতে শুরু করে ডিসি-১০। অতি উৎসাহী আলোকচিত্রীরা তার পিছু ধাওয়া করেন। কী কারণে যেন আমরাও তাঁদের দলে ভিড়ে যাই। তাকিয়ে থাকি, যতক্ষণ না ডিসি-১০ পুরোপুরি মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।