ছাত্রদলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে শিক্ষকেরা!

ARTঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কমিটি গঠনে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েছেন বিএনপি-জামায়াত সমর্থক সাদা দলের শিক্ষকদের একটা অংশ। বিএনপির চেয়ারপারসন ছাত্রদলের নতুন কমিটি করার যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে কারা নেতৃত্বে থাকবে তা ঠিক করতে কাজ করছেন এ শিক্ষকেরা। গত দুদিন ধরে এমন অন্তত তিনজন শিক্ষকের কাছে গিয়ে আগ্রহী ছাত্ররা একধরনের সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। 
ছাত্রদল ও সাদা দলের শিক্ষকদের একাধিক সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকেরা আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি স্বীকার করতে চান না। অনানুষ্ঠানিকভাবে দুজন শিক্ষক বলেছেন, তাঁরা ছাত্রদলের সম্ভাব্য নেতাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন, তথ্য সংগ্রহ করছেন। সে জন্য আগ্রহী ছাত্রদল কর্মীরা তাঁদের কাছে আসছেন। 
এ নিয়ে ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির একাংশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এই নেতারা দাবি করেছেন, অতীতে কখন এভাবে প্রকাশ্যে শিক্ষকেরা ছাত্রসংগঠনের কমিটি নির্বাচনের যুক্ত হয়েছেন বলে তাঁদের জানা নেই। এটা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে।
ছাত্রসংগঠনগুলোর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপিপন্থী প্রভাবশালী শিক্ষকেরা পরোক্ষভাবে কিছু ভূমিকা রাখেন। তবে এবার ছাত্রদলের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে যা হচ্ছে এমনটা প্রকাশ্যে কখনো দেখা যায়নি।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান বলেন, ‘শুনেছি, একসময় অনানুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকদের একটি মূল্যায়ন নেওয়া হতো। তবে এখন আমাদের সংগঠনে কাউন্সিলের মাধ্যমেই কমিটি করা হয়। কাউন্সিল করা না গেলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় কমিটির মতামতের ভিত্তিতে তা করা হয়।’
ছাত্রদল ও সাদা দলের শিক্ষকদের একাধিক সূত্র জানায়, সাদা দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির একজন সাবেক সহসভাপতি মূলত ছাত্রদলের নেতা নির্বাচনের বিষয়টি দেখভাল করছেন। বিজ্ঞানের ওই শিক্ষককে সহযোগিতা করছেন আরও কয়েকজন শিক্ষক। এঁদের বেশির ভাগই কার্জন হলকেন্দ্রিক। তাঁরা নিয়মিত ছাত্রদের পাশাপাশি অনিয়মিত হিসেবে কারা কারা এখনো বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি হয়ে ছাত্রত্ব ধরে রেখেছেন তাঁদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। ছাত্রদলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন পদপ্রত্যাশী কর্মী শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছেন। দুপুর নাগাদ এঁরা আলাদাভাবে তিনজন শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করেন। এঁদের একজন দেখা করেন অমর একুশে হলের সাবেক একজন প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে। ছাত্রদলের ওই কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি (সম্ভাব্য কমিটিতে) সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী। স্যারের সঙ্গে দেখা করেছি। সংগঠনে আমার অবদানের কথা তাঁকে জানিয়েছি।’ তিনি নিজ ও প্রতিপক্ষ সংগঠনের কর্মীদের হাতে মার খাওয়ার (মাথায় কোপের দাগ দেখিয়ে) কথা ওই শিক্ষককে জানান।
সব দলই ছাত্র রাজনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে থাকে। বিশেষ করে যারা সরকারে থাকে তারা মনে করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণে থাকলে ছাত্র আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আবার যারা বিরোধী দলে থাকে তারা মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন জোরদার করা গেলে তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এই ক্যাম্পাসে বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল কার্যত অস্তিত্বশূন্য ছিল। সরকারবিরোধী আন্দোলনেও সংগঠনটি মাতৃ সংগঠনের চাহিদামতো কাজ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে বলে খোদ খালেদা জিয়া ক্ষোভ জানিয়েছেন। তিনি শিগগির নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে নতুন কমিটি করার উদ্যোগের কথা নেতাদের জানিয়ে দেন। 
দলীয় সূত্র জানায়, গত ২৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাদা দলের শিক্ষকেরা বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ছাত্রদের নিয়ে কমিটি করার পরামর্শ দেন তাঁকে। শিক্ষকেরা যুক্তি দেখান, ছাত্রদলের এখন যাঁরা নেতৃত্বে আছেন, তাঁদের ছাত্রত্ব না থাকায় তাঁদের পক্ষ নিয়ে বিএনপিপন্থী শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কোনোভাবে চাপে রাখতে পারছেন না। নিয়মিত ছাত্ররা নেতৃত্বে থাকলে তাঁদের হল ও ক্যাম্পাসে থাকাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁরা জোরালো অবস্থান নিতে পারেন।
কমিটিতে স্থান পেতে ছাত্রদল কর্মীরা দেখা করছেন এমন দুজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সাদা দলের শিক্ষকেরা এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছেন না। তার কারণ, প্রশাসন জানে শিক্ষকেরা যাই করুক তাঁদের কিছু নীতিগত সীমাবদ্ধতা আছে। এ অবস্থায় ছাত্রদল ক্যাম্পাসে শক্ত অবস্থান নিতে পারলে প্রশাসন বাড়তি চাপ অনুভব করবে। এতে সাদা দলের শিক্ষকদের কদর বাড়বে। তবে তাঁদের একজন এও বলেন, নীতিগতভাবে এ বিষয়টি হয়তো সমর্থনযোগ্য নয়। 
জানতে চাইলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠন থেকে এখনো এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে তাঁরা জানতে পেরেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু শিক্ষক ছাত্রদল কর্মীদের ডেকে নিয়ে কথা বলছেন, সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। তিনি বলেন, এতে সংগঠনের শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায়ই সবকিছু হওয়া ভালো এবং শেষ পর্যন্ত তাই হবে বলেই তাঁরা মনে করেন।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন এমন একজন শিক্ষক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা খালেদা জিয়াকে বলেছেন, একেবারে নিয়মিত না হলেও এমন নেতাদের নেতৃত্বে নিয়ে আসা হোক যাঁরা অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি আছে। তখন খালেদা জিয়া শিক্ষকদের ছাত্রদলের কর্মীদের বিষয়ে খোঁজখবর করার জন্য বলেন। সে হিসেবে কয়েকজন শিক্ষক এ বিষয়ে কাজ করছেন। 
ছাত্রদলের সূত্র জানায়, গত সোমবার ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে খালেদা জিয়া জানতে চেয়েছিলেন, ২৯ ডিসেম্বর ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ কর্মসূচিতে শিক্ষকেরা রাস্তায় নেমে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। তখন ছাত্রদল কেন পাশে ছিল না। এর সদুত্তর দিতে না পারলেও একজন নেতা বলেন, শিক্ষকদের মধ্যেও ঝামেলা আছে। তাঁরা গত পাঁচ বছরে ক্লাস বর্জনের মতো কোনো কর্মসূচিতে যাননি। তখন খালেদা জিয়া বলেন, আন্দোলনে ছাত্রদল যদি মাঠে থাকত তাহলে হয়তো শিক্ষকেরা সে ধরনের কর্মসূচিতে যেতে পারতেন।
সাদা দলের আহ্বায়ক সদরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষকদের কোনো পছন্দ-অপছন্দ নেই। ছাত্রদলের কমিটি গঠন রাজনৈতিক বিষয়। খালেদা জিয়া বলেছিলেন, যদি কিছু পরামর্শ থাকে দেওয়ার জন্য। এখন কেউ চাইলে সে পরামর্শ দিতে পারেন।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি যদি সত্য হয়ে থাকে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। শিক্ষক রাজনীতি এখন এমনিতেই বিতর্কিত। শিক্ষকেরা সাদা-নীলে বিভক্ত হয়ে লেজুড়বৃত্তি করছেন। এর মধ্যে শিক্ষকেরা ছাত্র রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে গেলে তা ভুল বার্তা দেবে। মনে হবে, দলীয় স্বার্থে শিক্ষকেরা সব করতে পারেন, এমনকি ছাত্রদেরও ব্যবহার করতে পারেন। শিক্ষকেরা যদি সত্যি সত্যি এ ধরনের কাজ করেন তাহলে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হবে। একসময় দেখা যাবে ছাত্ররা শিক্ষকদের ওপর খবরদারি করছেন।

ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপন
addd
addd
addd
addd

Perfect Facebook Like Box Sidebar